খুলনা, বাংলাদেশ | ২১ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ৬ মার্চ, ২০২৫

Breaking News

একসঙ্গে ৬ হাজার রোজাদারের ইফতার, চলবে রমজানজুড়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা আহছানিয়া মিশনে প্রায় ৯০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ইফতার মাহফিল। খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ (রা.) ১৯৩৫ সালে মিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে রমজান মাসে ইফতারের আয়োজন শুরু হয়, যা সময়ের পরিক্রমায় দেশের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী ইফতার মাহফিলে পরিণত হয়েছে।

নলতা শরীফে প্রতিদিন ৬ হাজার রোজাদার একত্রে বসে ইফতার করেন, যা ধর্মীয় সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই ঐতিহাসিক ইফতার আয়োজনে অংশগ্রহণ করে এক আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করেন।

কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের (ভারপ্রাপ্ত) সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর প্রথম রমজান থেকে ৩০ রমজান পর্যন্ত ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে এখানে প্রতিদিন ছয় হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। হযরত খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ (রা.) এই আয়োজন চালু করেন, যা সময়ের সঙ্গে আরও প্রসারিত হয়েছে। শুরুতে ইফতারের আয়োজন সীমিত ছিল। কিন্তু এখন এটি দেশের সবচেয়ে বড় ইফতার মাহফিলে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ইফতারের জন্য সাত রকমের খাবার পরিবেশন করা হয় যেমন, খেজুর, ছোলা, শিঙ্গাড়া, ফিরনি, চিঁড়া, কলা ও ডিম। পুরো আয়োজনের ব্যয় প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা আমাদের পীর কেবলার আশেক বৃন্দ ও ভক্তরা বহন করেন। অতীতে আমরা আশপাশের এতিমখানা ও মসজিদে আরও চার হাজার ইফতার সরবরাহ করতাম, তবে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে সেটি আপাতত বন্ধ রয়েছে।

এই বিশাল ইফতার আয়োজন সফল করতে প্রতিদিন সকাল থেকে রান্নার কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে রান্নার দায়িত্বে থাকা বাবুর্চি মোকতার হোসেন বলেন, প্রতিদিন ভোর থেকে কাজ শুরু করি, রান্না শেষ করতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময় লাগে। এখানে আমাদের কোনো কষ্ট হয় না, কারণ কাজ ভাগ করে দেওয়া থাকে। এত বড় আয়োজন করতে পারাটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।

এই আয়োজনে কাজ করেন প্রায় ৩০০ স্বেচ্ছাসেবক, যারা বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন।

স্বেচ্ছাসেবক আরিফুল ইসলাম, যিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই কাজে যুক্ত। তিনি বলেন, আমি চাকরি করি, কিন্তু চাকরির পর এখানে এসে কাজ না করলে আত্মতৃপ্তি পাই না। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন, শুধুমাত্র এই পবিত্র আয়োজনের অংশ হতে। প্রতি বছর ৩ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজাদারদের সম্মানার্থে কাজ করেন। কোনোরকম বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ইফতার বণ্টন করা হয়, যাতে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে ইফতার করতে পারেন।

সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নলতা শরীফের ইফতার মাহফিলে যোগ দিতে এসেছেন এস এম বিপ্লব হোসেন। তিনি বলেন, আমি বিশেষভাবে নলতা শরীফের ইফতার মাহফিলে অংশ নিতে এসেছি। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইফতার আয়োজন, যেখানে ছয় হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন। এত মানুষের সঙ্গে বসে ইফতার করা এক অসাধারণ অনুভূতি। কার দোয়া কখন কবুল হয়, তা বলা যায় না। আমি আশা করি, এই ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা আমার দোয়াও কবুল করবেন।

আশাশুনি উপজেলার জাকির হোসেন বলেন, খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ (রা.) এর পাক রওজা শরীফ পবিত্র স্থান হিসেবে সমাদৃত। প্রতি বছর এখানে ইফতার করতে আসি। এটি শুধু ইফতার নয়, বরং ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

রেডিও নলতার স্টেশন ম্যানেজার মামুন হোসেন বলেন, নলতা শরীফ সাতক্ষীরার মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। পীর সাহেবের মাজারকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত এখানে সমবেত হন। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে, সারাদিন রোজা রাখার পর একসঙ্গে ইফতার করার যে অনুভূতি, তা সত্যিই অসাধারণ। এটি শুধু ধর্মীয় আয়োজন নয়, বরং সামাজিক সংহতিরও প্রতীক।

নলতা আহছানিয়া মিশনের ইফতার মাহফিল শুধু সাতক্ষীরা নয়, সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি অনন্য আয়োজন। প্রতিবছর বিভিন্ন জেলা থেকে হাজারও মানুষ এখানে আসেন শুধুমাত্র এই বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী হতে। এই বিশাল আয়োজনের পেছনে রয়েছে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক, বাবুর্চি ও আয়োজকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। তাদের প্রচেষ্টায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় প্রতি রমজান মাসে হাজারও মানুষ একত্রিত হয়ে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেন।

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, সামাজিক সংহতি ও আত্মার প্রশান্তির এক মহতী উদাহরণ হয়ে উঠেছে নলতা শরীফের এই ইফতার মাহফিল। এই আয়োজন যেন ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হয়, সেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!